Blue- ইকোনমি বনাম বাংলাদেশঃ



ব্লু-ইকোনমি বলতে এককথায় বোঝায় সমুদ্রজাত সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি প্রথম ব্লু-ইকোনমির ধারণা দেন। বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে আলোচিত সম্ভাবনাময় ব্লু-ইকোনমি নিয়ে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী  ২০১২ তে মিয়ানমারের সাথে আর ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিস্পত্তি হ্ওয়ায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশী টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকার অধিকার অর্জন করে বাংলাদেশ। যার সাথে আছে ২০০ নটিক্যাল মাইল ( ১ নটিক্যাল মাইল= ১.৮৫ কিমি ) একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণীজ-অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার। এ রায়ের ফলে বাংলাদেশের স্থলভাগের বাইরে জলসীমায়ও আরেক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ১ লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বাংলাদেশের জন্য ১ লক্ষ ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সমুদ্রসীমা আরেকটা গোটা বাংলাদেশই বটে। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রে বিরোধপূর্ণ ১৭ টি ব্লকের ১২টি পেয়েছিল বাংলাদেশ সাথে ভারতের দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই ।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এশিয়ার অন্যতম জ্বালানি শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ অবস্থান করবে অদূর ভবিষ্যতে কারণ বঙ্গোপসারের নিচে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদ রয়েছে যা আগামী দিনের জ্বালানি-রাজনীতি ও অর্থনীতিকে সন্দেহাতীতভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে । গ্যাস ও তেল ছাড়াও বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ ভারি খনিজের সন্ধানও পাওয়া গেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে ১৩টি জায়গায় আছে সোনার চেয়ে অধিক মূল্যবান বালি, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম। যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট। তাছাড়া সমুদ্রের অগভীরে জমে আছে হিমালয় পরিমাণ ‘ক্লে’। এই ক্লে উত্তোলন সম্ভব হলে সিমেন্ট কারখানাগুলো আরও শক্তিশালী হবে বাণিজ্যিকভাবে। এসব সম্পদ থেকে বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত তথ্যমতে স্থলভাগের ৮১ গুণ সম্পদ রয়েছে আমাদের সমুদ্রসীমায়।
বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী ৩ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা আসে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে। গভীর সমুদ্রের ন্যায্য অধিকার পাওয়ায় মৎস্য আহরণের বিপুল সম্ভাবনাও দেখছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে, এ অঞ্চলের টুনা মাছ সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। সুস্বাদু ও দামী টুনা মাছ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের হোটেলগুলোতে আমদানি করা হয়ে থাকে। টুনা মাছের বিচরণ গভীর সমুদ্রে। তবে এখন মালিকানা অধিকারে বাংলাদেশের ফিশিং ট্রলার গভীর সমুদ্রে টুনাসহ অন্যান্য মাছ আহরণের সুযোগ পাচ্ছে। মৎস্য আহরণের পাশাপাশি সমুদ্রের তীরবর্তী পর্যটনকেন্দ্রের মাধ্যমেও অর্থনৈতিক বিপ্লবের সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সমুদ্র নির্ভর। বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানির ৯০ শতাংশই সম্পাদিত হয় সমুদ্র পথে। তা ছাড়া, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র-বন্দর দিয়ে প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ২ হাজার ৬ শত জাহাজের মাধ্যমে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি রফতানি হয়। এসব জাহাজ থেকে ভাড়া বাবদ আয় হয় ৬ বিলিয়ন ডলার। ভবিষ্যতে এসব সমুদ্র বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বৃদ্ধি পাবে সে সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও গবেষণার সুযোগ। পূর্বে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান করার জন্য  আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করার পরও কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সাড়া পাওয়া যেতোনা। সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে  বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উত্সাহী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।  গভীর সমুদ্র থেকে জলযান বাংলাদেশ সীমায় প্রবেশ করার সমস্যা থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্র নির্ভর ঔষুধশিল্পও গড়ে তোলা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) অন্যতম পরিচালক ইন্দ্রয়োনো সয়েসিলো। তিনি আরো বলেছেন, ব্লু-ইকোনোমি একাধারে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিধান করতে পারে এবং জিডিপি বৃদ্ধি করে জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধশালী করতে পারে।
সারা বিশ্বজুড়ে ব্লু ইকোনমি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বিগত বছরগুলোতে সংঘটিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে ব্লু-ইকোনোমি ছিল মুখ্য আলোচনার বিষয়। ২০১২ তে রিও+২০, সমুদ্র বিষয়ক এশীয় সম্মেলন, ২০১৩ সালে বালিতে অনুষ্ঠিত খাদ্য নিরাপত্তা এবং ব্লু গ্রোথ ইত্যাদি সম্মেলনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উন্নয়ন সংস্থা (OECD), জাতি সংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP), বিশ্ব ব্যঙ্ক, ফাউ (FAO), ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন (EU) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উন্নয়ণ কৌশলের মূলেও ছিলো ব্লু-ইকোনোমি।
বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতির অবদান বহুবিধ। বছরব্যপী ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। বিশ্বের কোটি মানুষের ১৫-৩০ ভাগ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০-৪০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানী তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সম্পদ বাংলাদেশকে এনে দিতে পারে আগামী দিনের অর্থনৈতিক ভারসাম্য, জ্বালানি নিরাপত্তা। সমুদ্রে প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, জিডিপি বাড়িয়ে দিতে পারে খুব সহজেই। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাবার, তেল, গ্যাস ও খনিজ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব। অন্যদিকে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে সমুদ্র নির্ভর ব্লু ইকোনোমির বদৌলতে।  বাংলাদেশকে উন্নত দেশের তালিকায় নিয়ে যেতে ব্লু-ইকোনোমির অগ্রযাত্রা এখন তাই সময়ের দাবি।

অন্তর সরকার
ফিশারিজ অনুষদ
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঝিনুক থেকে মুক্তা তৈরির রহস্য.......

মাছ, পোল্ট্রি, প্রাণিখাদ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্ল্যাক সোলজার মাছির (Black soldier fly) লার্ভা:

মাছের আঁইশের নানাবিধ ব্যবহারঃ