কাপ্তাই লেকে প্রথমবারের মতো নিজস্ব রিসার্চ ভেসেল নামানোর উদ্যোগ সিভাসুর:

Copyright: chittagong.com

মূলত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৫৬ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মনুষ্যসৃষ্ট স্বাদুপানির হ্রদ কাপ্তাই লেকের সৃষ্টি হলেও মৎস্য, কৃষি, যোগাযোগ ও পর্যটন খাতে এই লেকের ভূমিকা সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগত। দেশি ও বিদেশি দর্শনার্থীদের কাছে কাপ্তাই লেক খুবই আকর্ষণীয় স্থান। লেক তীরবর্তী এলাকাসমূহ কৃষি ক্ষেত্রে সমূহ অবদান রাখে। এছাড়াও কাপ্তাই লেক মৎস্য খাতে এক অপার সম্ভাবনার নাম। প্রায় ৭০ প্রজাতির দেশি ও ৮ টি বিদেশী প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এই লেকে, যাদের মধ্যে আটটি প্রজাতির মাছের বাণিজ্যিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এগুলি হচ্ছে কাতলা, মৃগেল, রুই, কালিবাউস, ঘনিয়া, চিতল, বোয়াল এবং চাপিলা। এই জলাধারের উৎপাদিত মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও দেশের অন্যান্য এলাকায় চালান করা হয়। বার্ষিক মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ ১০,০০০ টনেরও বেশি।
কিন্তু বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে লেকটি দিনে দিনে হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক নাব্যতা ও গভীরতা, বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে মহাশোল, পিপলা শোল, বাঘা আইড়, নান্দিনা ইত্যাদি মৎস্য প্রজাতি এবং বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে বাচুয়া বাচা, ভাঙ্গন বাটা, সরপুঁটিসহ মোট ১৮ টি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। কাপ্তাই লেক একসময় কার্পজাতীয় মাছের প্রজননের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মাছের প্রজনন পরিবেশও ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছে এই হ্রদটি।
মৎস্য বিধির বাস্তবায়ন ও উন্নত ব্যবস্থাপনার প্রবর্তনের জন্য কাপ্তাই লেক নিয়ে রয়েছে ফলপ্রসূ গবেষণার প্রয়োজন। তাই কাপ্তাই লেকের সর্বোপরি ব্যবস্থাপনা করার লক্ষ্যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে চলেছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, (সিভাসু)। অতি শীঘ্রই কাপ্তাই লেকে নিজস্ব রিসার্চ ভেসেল নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে সিভাসু্র গবেষক দল। এই গবেষণা কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে-
- বিভিন্ন প্রজাতির মাছের স্টক অ্যাসেসমেন্ট করা
- মাছের অভয়াশ্রম সৃষ্টির জন্য স্থান নির্বাচন করা
- সময়ের সাথে লেকের বিভিন্ন ভৌত রাসায়নিক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা
- বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতির পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখা
- কাপ্তাই লেকের নিজস্ব প্রজাতি ছাড়াও অন্যান্য প্রজাতির মাছ খাঁচায় ও পেন কালচার প্রক্রিয়ায় চাষ করা
- কাপ্তাই লেকে চাষযোগ্য সম্ভাব্য প্রজাতি বের করা
- বিভিন্ন মাছের প্রজনন ক্ষেত্রের বাস্তব অবস্থা নিরুপণ করা
- প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়ায় উপযুক্ত কারণ বিশ্লেষণ করা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা
- স্থানীয় জনশক্তিকে খাঁচায় ও পেন কালচারের মাধ্যমে মাছ চাষে উদ্যোগী করা
- মাছের পোনা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য লেকের উপযুক্ত অবস্থা নিরুপণ ও পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা
- ক্রিক কালচার বা ঘোনায় মাছ চাষের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো যাচাইকরণ
- কাপ্তাই লেকে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের বিস্তৃতির বর্তমান অবস্থা নিরুপণ ও প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদন বাড়াতে করণীয় বিষয় বিবেচনা করা
- কাপ্তাই লেক ভরাট হওয়ার জন্য দায়ী কারণগুলো বিশ্লেষণ করা এবং সম্ভাব্য ব্যবস্থা নিরুপণ করা
- কাপ্তাই লেকের দূষণ দূরীকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা
- অতিমাত্রায় ও অবৈধভাবে মাছ আহরণ বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া
কাপ্তাই লেক ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন কর্তৃক জারিকৃত ফিশ ট্রেডার লাইসেন্স, মাছের পোনা অবমুক্তকরণ, খাঁচা ও ঘোনায় মাছ চাষ, নিষিদ্ধ জাল জব্দ করা,মাছের অভয়াশ্রম সৃষ্টি করা, অতিমাত্রায় আহরণ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী। তাছাড়া মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা এবং উক্ত সময়ে জেলেদের ভর্তুকি প্রদান করা, জেলে নিবন্ধন কর্মসূচী, পাহাড়ে বিশেষ প্রযুক্তি ক্রিক কালচার বা ঘোনায় ব্য মাছ চাষ করা ইত্যাদি। ৫৮,৩০০ হেক্টরের এই বিশাল জলাভূমির মাছ উৎপাদন মাত্র ১০,০০০ মেট্রিক টন, যা সত্যি কাম্য নয় যেখানে পুকুরেই প্রতি একরে ৪৫০০ কেজি মাছ অতি সহজেই উৎপাদিত হচ্ছে।
সিভাসুর রিসার্চ ভেসেলটি কাপ্তাই লেকের বিলুপ্ত প্রজাতিসমূহের পুনরুদ্ধার ও বিপন্নপ্রায় প্রজাতির অভয়ারণ্য সৃষ্টি করার লক্ষ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সিভাসু রিসার্চ ভেসেলের মাধ্যমে সিভাসু রিসার্চ টিমের সাথে বি এফ আর আই, ডিপার্টমেন্ট অব ফিশারিজ, নেভি, কোস্টগার্ড সবার সম্মিলিত উদ্যোগে অতি শীঘ্রই কাপ্তাই লেকের বিলুপ্ত প্রায় মৎস্যসম্পদের পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে ও কাপ্তাই লেকের সমূহ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কাপ্তাই লেকে সিভাসুর রিসার্চ ভেসেল উদ্বোধন ও পরিচালনার কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। উক্ত রিসার্চ ভেসেলের অবকাঠামো নির্মাণও প্রায় শেষের পথে।অদূরেই কাপ্তাই লেকের অস্তিত্ব রক্ষার্থে কার্যকর হবে এই উন্নত রিসার্চ ভেসেলটি।
কাপ্তাই লেক আমাদের দেশের এক অনন্য সম্পদ। মৎস্য ক্ষেত্রে বিজয়ের মশাল হাতে এগিয়ে চলা আমাদের এই জয়যাত্রা আরো এগিয়ে নিতে সিভাসু কর্তৃক কাপ্তাই লেকে এই রিসার্চ ভেসেল পরিচালনার উদ্যোগ আমাদের দেশের জন্য হবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। এই উদ্যোগের মাধ্যমেই কাপ্তাই লেকের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হবে ও আমাদের অভ্যন্তরীণ মৎস্যসম্পদের সমূহ উন্নয়ন সাধন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

অন্তর সরকার
"ফ্যাকাল্টি অব ফিশারিজ"
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, (সিভাসু)

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঝিনুক থেকে মুক্তা তৈরির রহস্য.......

মাছ, পোল্ট্রি, প্রাণিখাদ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্ল্যাক সোলজার মাছির (Black soldier fly) লার্ভা:

মাছের আঁইশের নানাবিধ ব্যবহারঃ