অ্যান্টিবায়োটিক বনাম ইমিউনোস্টিমুলেন্ট, অ্যাকুয়াকালচার ও পোল্ট্রিখাতেঃ


বর্তমানে মৎস্য, পোল্ট্রি খামার সবখানেই আলোচিত একটি ত্রাসের নাম হলো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতে অ্যন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় সাধারণত ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগবালাই থেকে প্রতিকার ও মড়ক থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য। ভেটেরিনারি ও অ্য্যকুয়াকালচার সেক্টরে পরিচিত কিছু অ্যন্টিবায়োটিক হলো Cephalosporins, Penicillin G, Erythromycin, Amoxicillin, Tilmicosin Phosphate, Spectinomycin, Chloramphenicol, Chlortetracycline, Oxytetracycline, Tetracycline, Sarafloxacin ইত্যাদি।

প্রত্যেক প্রাণির দেহে অ্যান্টিবায়োটিকসমূহ ব্যাক্টেরিয়ার ধরণ, ব্যাপ্তি, বিস্তৃতি  ইত্যাদি অনুসারে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা ও সময়কাল ধরে প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু এই অ্যান্টিবায়োটিকের নির্ভুল ও পরিমাণমত ব্যবহার সবক্ষেত্রে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়না যার ফলস্বরুপ আমাদের ভুগতে হয় নানান শারীরিক সমস্যায়। বিশেষত, মাছ চাষের ক্ষেত্রে যখন কোন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয় তখন তা আক্রান্ত এবং সুস্থ উভয় ধরণে্র মাছেই খাদ্য বা মেডিসিনের মাধ্যমে প্রবেশ করে থাকে।

অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ব্যবহৃত এসব অ্যান্টিবায়োটিক মাছ বা মুরগির টিস্যু, যকৃত ও অন্যন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জমা হয়  এবং খাদ্যের মাধ্যমে  আমাদের দেহে প্রবেশ করে । এর ফলে দেহের উপকারী অণুজীবগুলো মারা যায় এবং ক্ষতিকর অণুজীবগুলো এইসব অ্যন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। অ্যন্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট জিন (ARG) এর সমন্বয়ে মাল্টিড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট স্ট্রেইন (MDR) এর উন্নতি হওয়ার কারণে উপরোক্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলস্বরুপ, কোন অসুখের জন্য আমরা যখন অ্যান্টিবায়োটিক খাই তখন তা আর কার্যকর হয়না বরং সৃষ্টি করে কিডনীর সমস্যাসহ নানান শারীরিক জটিলতার। এক গবেষণায় দেখা গেছে মুরগির শরীরে এবং ডিমে পাওয়া যাচ্ছে মানুষের শরীরের সহনীয় মাত্রা থেকে প্রায় ৫ গুণ বেশি সিফ্রোফ্রক্সসিন অ্যান্টিবায়োটিক। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায় ঢাকা শহরের ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত ৫০.৭ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ কোনপ্রকার ফল দিচ্ছেনা।

এবার আসা যাক ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট (Immunostimulant) এর প্রসঙ্গে। সাধারণত ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট বলতে বোঝায় কোন পদার্থ, পুষ্টি উপাদান, এনজাইম, হরমোন, গাছ বা অন্য প্রাণি থেকে আহরিত এমন কোন উপাদান যা প্রাণিদেহের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (Immunosystem) আরো সক্রিয় করে তোলে কোন প্রকার ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াই। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস উভয়ই প্রতিরোধ করতে পারে। ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট সাধারণত খাবারের সাথে প্রয়োগ করতে হয় এবং এরা দেহের শ্বেতরক্তকণিকার (Leucocyte) ফ্যাগোসাইটিক (Phagocytic) কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে নির্দিষ্ট রোগজীবাণু ধ্বংস করে রোগবালাই প্রতিরোধ করে থাকে। অ্যাডজুভেন্ট (Adjuvant) হলো প্রাণিদেহে ব্যবহৃত প্রথম ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট  যেটির উপাদান হলো অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও প্যারাফিন অয়েল। পোল্ট্রি ও অ্যাকুয়াকালচারে বিশ্বব্যাপী আলোচিত একটি ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট হলো গ্লুকান (Glucan) যেটি উদ্ভিদ, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাকের কোষ প্রাচীর থেকে আহরিত গ্লুকোজের একজাতের পলিমার। বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া তথ্যমতে, ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট ব্যবহার করে পোল্ট্রি, মৎস্য ও চিংড়ী চাষে নিম্নোক্ত অণুজীব এর সংক্রমণ যেমন ব্যাক্টেরিয়াঃ Aeromonas hydrophila, A. salmonicida, Edwardsiella tarda, E. ictaluri, Vibrio anguillarum, V. vulnificus, V. salmonicida, Yersinia ruckeri, Streptococcus spp.; এবং ভাইরাসঘটিত Infectious hematopoietic necrosis, yellow head virus, viral hemorrhagic septicemia পরজীবী Ichthyopthirius multifiliis এর সফল প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে। 

প্রচলিত কিছু ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট এর মধ্যে রয়েছেঃ
১) ব্যাকটেরিয়া উপজাতঃ        MDP (Muramyl dipeptide from Mycobacterium species), Lipopolysaccharide (LPS), Freund’s complete adjuvant (FCA), EF203 (fermented egg product), Peptidoglucan (from Brevibacteriumlactofermentumand Vibrio sp.), Clostridium butyricum cells, Achromobacterstenohaliscells, Vibrio anguillarumcells (Vibrio vaccine)
২) ঈস্ট উপজাতঃ b-1, 3 glucan, b-1, 6 glucan
৩) পুষ্টি উপাদানঃ Vitamin C and E, n-3 fatty acid
৪) হরমোনঃ  Prolactin, tri-iodothyronine
৫) পলিস্যাকারাইডঃ      Chitosan, Chitin, Lentinan, Schizophyllan, Oligosaccharide
৬) উদ্ভিদ ও প্রাণি উপজাতঃ Ete (tunicate), Hde (Abalone), Glycyrrhizin, Firefly squid, Quillaja, Saponin (Soap tree)
৭) অন্যান্যঃ Lactoferrin, Soyabean protein, Quil A, Spirulina, Achyranthesaspera (Herb), Mucorcircinelloides (Fungi)

উক্ত ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট সমূহ ব্যবহার করে যথেষ্ট ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে কোনপ্রকার বিরুপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই।

চীন, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট এর ব্যবহার প্রচলিত হলেও আমাদের দেশের মানুষ এসম্পর্কে খুব কমই অবগত। আমাদের পোল্ট্রি ও অ্যাকুয়াকালচার খাতে অ্যান্টিবায়োটিকের সর্বোত্তম বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট। এতে করে চলমান অ্যান্টিবায়োটিক প্রহসন থেকে দেশের জণগণ মুক্তি পাবে অচিরেই। ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট ব্যবহারে প্রসার ঘটাতে আমাদের প্রয়োজন উপযুক্ত গবেষণা ও সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ের হস্তক্ষেপ। দেশীয় গাছপালা ও অন্যান্য উৎস থেকে ইমিউনো-স্টিমুলেন্ট আহরণ করে পোল্ট্রি ও মৎস্যখাতে এর প্রচলন ঘটাতে পারলেই অদূরেই আমরা অ্যান্টিবায়োটিকের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবো এই আশা ব্যক্ত করা যায়।

তথ্যসূত্রঃ Journal of Marine Science: Research & Development, Elsevier, American journal of medicine, FAO, The new England journal of medicine, WHO

অন্তর সরকার
ফিশারিজ ২য় বর্ষ
Email: antorsarkar1@gmail.com
“চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়”  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঝিনুক থেকে মুক্তা তৈরির রহস্য.......

মাছ, পোল্ট্রি, প্রাণিখাদ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্ল্যাক সোলজার মাছির (Black soldier fly) লার্ভা:

মাছের আঁইশের নানাবিধ ব্যবহারঃ