“পুকুর হোক আয়ের উৎস, দূর হোক বেকারত্ব”

অন্তর সরকার, ফিশারিজ ১ম বর্ষ
“চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সাইন্সেস ইউনিভার্সিটি “

কখনো ভেবে দেখেছেন কি? আপনার বাড়িতে পড়ে থাকা পুকুর বা ছোট জলাশয়টি বদলে দিতে পারে আপনার জীবন। আপনিও হতে পারেন সচ্ছল।এটি কোন জল্পনা কল্পনা নয়। হ্যাঁ ঠিকই ভাবছেন যে আমি মাছ চাষের কথাই বলছি। আপনার বসত বাড়ির ওই জলাশয়টিতে মাছ চাষ করেই আপনার জীবনে আনতে পারেন সাফল্যমাছ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মৎস্য সম্পদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মাছ চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, যেমন-একই পুকুরে নানা জাতের মাছ চাষ করা যায়, খাল ও ডোবায় মাছ চাষ করা যায়, আবার চৌবাচ্চায়ও মাছের চাষ করা যায়। এটি কৃষির মতই একটি চাষাবাদ পদ্ধতি। আবার কোন নির্দিষ্ট জলাশয়ে পরিকল্পিত উপায়ে স্বল্প পুঁজি, অল্প সময় ও লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছের উৎপাদনকে মাছ চাষ বলে। মূলত বিভিন্ন নিয়ম মেনে প্রাকৃতিক উৎপাদনের চেয়ে অধিক মাছ উৎপাদনকেই মাছ চাষ বলা হয়। ঠিক নিয়ম ও পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে পাল্টে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। এ দেশের শিক্ষিত বেকার যুবসমাজ কর্মসংস্থানের আশায় নিরন্তর চেষ্টা করছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত স্বপ্ন বাস্তবায়ন অনেকেরই হচ্ছে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন জীবনের পথচলায়। জীবনের বেকারত্বের গ্লানি মোছার জন্য এখন অনেকেই মাছ চাষের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। বর্তমানে যে হারে দেশে মাছ চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা যদি চলমান রাখা যায় তবে অতি অল্প সময়ে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হবে এবং পাশাপাশি দেশে বড় আকারের উন্নয়নমূলক পরিবর্তন আসতে পারে। মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন দেশের লক্ষাধিক মানুষ। আর মাছ চাষের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। বর্তমানে স্থানীয় বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ক্রমাগত ফিশারিজের সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও স্বাধীনতা-পরবর্তী ফিশারিজ থেকে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১.৬ গুণ। দেশে প্রতিনিয়তই মাছ চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছের চাষাবাদে পিছিয়ে আছে দেশ। এক্ষেত্রে গুণগত মানের হ্যাচারির অপর্যাপ্ততা ও চাষের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করাকে দায়ী করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার-২০১৬’ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ফিশারিজ পদ্ধতিতে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মৎস্য চাষ ও মৎস্য সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ নারী মৎস্য খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, গত সাত বছরে মৎস্য খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অতিরিক্ত প্রায় ছয় লক্ষাধিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
পুকুরে মাছ চাষ
নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে পুকুরে মাছ চাষ করা যায় :
১. সনাতন পদ্ধতির মাছ চাষ : এ পদ্ধতিতে পুকুরের কোন ব্যবস্থাপনা ছাড়াই মাটি ও পানির উর্বরতায় পানিতে যে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় মাছ তাই খেয়ে জীবন ধারণ করে। এক্ষেত্রে আলাদা কোন পরিচর্যা নিতে হয় না।
২. আধা-নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ : এ পদ্ধতিতে নিয়মমতো পুকুর প্রশস্ত করে আংশিক সার ও খাদ্য সরবরাহ করে মাছের খাদ্য উৎপন্ন করতে হয়। পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপাদিত খাদ্যের সঠিক ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য রেখে মাছের পোনা ছাড়তে হয়।
৩. নিবিড় পদ্ধতির মাছ চাষ : অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে বেশি উৎপাদনের জন্য সার ব্যবাহার করে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হয়।
৪. কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ : পুকুরের বিভিন্ন স্তরে উৎপন্ন খাবার সম্পূর্ণ ব্যবহার করার জন্য রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, বিগহেড, সিলভারকার্প, কমনকার্প প্রভৃতি নানা প্রজাতির মাছ একত্রে চাষ করা যায়।
পুকুর নির্বাচন
১. পুকুরটি খোলামেলা জায়গায় এবং বাড়ির আশেপাশে হতে হবে।
২. মাটির গুণাগুণ পুকুরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি পুকুরের জন্য ভালো।
৩. পুকুরের আয়তন কমপক্ষে ১০ শতাংশ হতে হবে। ৩০ শতাংশ থেকে ১ একর আকারের পুকুর মাছ চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
৪. পুকুরের গভীরতা ২-৩ মিটার রাখতে হবে।
৫. পুকুর পাড়ে বড় গাছ বা ঝোপ-ঝাড় থাকা যাবে না।
পুকুর প্রস্তুত
পোনা মাছ ছাড়ার আগে পুকুর তৈরি করে নিতে হবে। সাধারণত পুরনো পুকুরই তৈরি করে নেওয়া হয়। পুকুর প্রস্ত্ততির কাজটি পর্যায়ক্রমে নিম্নরূপে করতে হবে :
১) জলজ আগাছা যেমন-কচুরিপানা, কলমি লতা, হেলেঞ্চা ইত্যাদি শেকড়সহ তুলে ফেলতে হবে।
২) রাক্ষুসে মাছ যেমন শোল, গজার, বোয়াল, টাকি ইত্যাদি এবং অবাঞ্ছিত মাছ যেমন-মলা, ঢেলা, চান্দা, পুঁটি ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলতে হবে।
৩) প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে পানি থাকলে ড্রামে বা বালতিতে গুলে ঠান্ডা করে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
৪) চুন দেওয়ার এক সপ্তাহ পর জৈব সার দিতে হবে।
মাটি ও পানির গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে
৫)পুকুর শুকনা হলে পুকুরে সার, চুন, গোবর সব ছিটিয়ে দিয়ে লাঙ্গল দিয়ে চাষ করে পানি ঢুকাতে হবে।
৬) পোনা মজুদের পূর্বে পুকুরে ক্ষতিকর পোকামাকড় থাকলে তা মেরে ফেলতে হবে।
৭) পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে পোনা মজুদ করতে হবে। মৃত্যুর হার যেন কম থাকে সেজন্য পোনার আকার ৮-১২ সে.মি. হতে হবে।
৮) এর পর নিয়মমত পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, যেমন



-পোনা হাড়িতে বা পলিথিন ব্যাগে আনা হলে, পলিথিন ব্যাগটির মুখ খোলার আগে পুকুরের পানিতে ২০-৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে।
-তারপর ব্যাগের মুখ খুলে অল্প করে ব্যাগের পানি পুকুরে এবং পুকুরের পানি ব্যাগে ভরতে হবে।
-ব্যাগের পানি ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা যখন সমান হবে তখন পাত্র বা ব্যাগের মুখ আধা পানিতে ডুবিয়ে কাত করে সমস্ত পোনা পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। সকাল ও বিকেলই পোনা ছাড়ার ভালো সময়।
৯) দিনে দুইবার অর্থাৎ সকাল ১০ টায় এবং বিকাল ৩ টায় খৈল, কুঁড়া, ভুসি ইত্যাদি সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
খাবারঃ
সুষম পুষ্টিকর খাদ্য ছাড়া মাছের সন্তোষজনক উৎপাদন আশা করা যায় না। সুষম খাদ্যের উপাদানগুলো হচ্ছে আমিষ, শ্বেতসার, ভিটামিন, তৈল, খনিজ লবণ ও পানি। প্রাকৃতিক নিয়মে পুকুরে মাছের যে খাবার (প্লাঙ্কটন) উৎপাদন হয়, তা মাছের সার্বিক পুষ্টি চাহিদা মেটাতে মোটেই যথেষ্ট নয়।
এ ছাড়া পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার তৈরির জন্য যে সার প্রয়োগ করা হয়, তাতেও মাছের খাদ্য ঘাটতি অপূরণীয়ই থেকে যায়। ফলে মাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় না।
প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার মাছের উৎপাদন বাড়াতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই স্বল্প সময়ে স্বল্পায়তনের জায়গা থেকে মাছের অধিক ফলন পেতে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।
মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য সচরাচর ব্যবহারযোগ্য উপাদানগুলো হচ্ছে চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, ফিশমিল, গরু-ছাগলের রক্ত, নাড়িভুঁড়ি, রেশম কীট এবং জলজ উদ্ভিদ যেমন, কচুরিপানা, খুদেপানা, কুটিপানা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, সুষম খাদ্য তৈরির জন্য সাধারণত মোট খাদ্যের ০.৫-২% ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ প্রয়োজন হয় এবং খাবার বেশি সময় স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বাইন্ডার হিসেবে আটা, ময়দা অথবা চিটাগুড়ের ব্যবহার অতীব জরুরি বিবেচনা করা হয়ে থাকে। পুকুরের মাছের ওজনের ৩%-৫% হারে ভাল কোম্পানি ফিড (মেগা, কোয়ালিটি, সৌদি, আফতাব ইত্যাদি ফিড) প্রতিদিন প্রয়োগ অথবা খৈল, চালের কুড়া, গমের ভূষি ১০০ কেজি মাছের জন্য ৩ কেজি খাবার (১.৫ কেজি একদিন পুর্বে ভিজিয়ে রাখা খৈল ও ১.৫ কেজি গমের ভুষি বা চালের কুড়া) মিশিয়ে ছোট ছোট মন্ড তৈরী করে পুকুরে প্রয়োগ করা। খাবারগুলো মাটির পাত্রে অথবা প্লাস্টিকের চটের উপর রাখলে ভাল হয় কারণ মাছ খাবার খেল কিনা তা সঠিকভাবে জানতে পারা যাবে। যদি ২ দিন পরও খাবার দেখা যায় তাহলে মাছের খাবার কমিয়ে দিতে হবে।  এক কেজি আদর্শ মাছের খাবার তৈরীতে গমের ভূষি ৩০০ গ্রাম, চালের কুড়া ২০০ গ্রাম, ফিসমিল ২০০ গ্রাম, আটা ১০০ গ্রাম, পুর্বে ভিজানো খৈল ২০০ গ্রাম সাথে ভিটামিন প্রিমিক্স ১ কেজি খাবারে ১ চা চামচ, লবন ১ চা চামচ, ও চিটাগুড় প্রয়োজন মত (মন্ড প্রস্ত্তত করতে যতটুকু প্রয়োজন ১০০-২০০ গ্রাম) মিশাতে হবে।

সতর্কতা

সঠিক পরিকল্পনা
মাছ চাষ শুরু করার আগে প্রয়োজন হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনা। কী মাছ চাষ করা হবে, চাষের মেয়াদ কতদিন হবে, কখন বাজার জাত করা হবে এবং এজন্য মোট কত খরচ হতে পারে, অর্থ ব্যয়ের সংস্থান আছে বা করা যাবে কি না এসব বিষয়ে পূর্ব পরিকল্পনা থাকতে হবে। তা না হলে চাষ শুরু করার পর নানা প্রতিবন্ধকতায় চাষি বাধ্য হয়েই মাছ চাষের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এর ফলে, প্রত্যাশিত উৎপাদন হয় না এবং বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে চাষি লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন।

পুকুর খননে সঠিক ধারণা থাকা
যেখানে পুকুর খনন করা হবে সেখানকার অবকাঠামো, পরিবেশ, পানির গভীরতা, বর্ষায় বন্যার হুমকি, পুকুর পাড়ের ঢাল, বকচর, শুষ্ক মৌসুমে পানি কতটা থাকে, পানি হ্রাস পেলে বাইরে থেকে পানি দেয়ার ব্যবস্থা আছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকলে পুকুর খননেই গলদ থেকে যাবে। আর গলদ থাকলে সারা বছর নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এজন্য প্রথমেই অভিজ্ঞ মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।

পুকুর প্রস্তুত যথার্থ না হওয়া
চাষ শুরু করার আগে বা মাছের পোনা ছাড়ার আগে সঠিক নিয়মে পুকুর তৈরি করা অত্যাবশ্যক। শুরুতে বিজ্ঞান ও পরিবেশসম্মত পুকুর তৈরি করা হলে মাছ চাষের এক তৃতীয়াংশ কাজ সম্পন্ন করা হয়। অথচ অনেক চাষি এক্ষেত্রে অদক্ষতার পরিচয় দেন। ভালভাবে পুকুর শুকানো, রাক্ষুসে মাছ অপসারণ, দূষণ মুক্ত পানি সরবরাহ করা, চুন/জিওলাইট প্রয়োগ, পানিতে প্রাকৃতিক খাবার জন্মানো এবং পুকুরে পানি প্রবেশ এবং নিষ্কাশনের রাস্তা সঠিকভাবে রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে অবহেলা করা হলে পরবর্তীতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়।

পোনা নির্বাচনে ত্রুটি
পোনার সঠিক মান এবং জাত নিশ্চিত করা না গেলে চাষি অনেক সমস্যায় পড়তে পারে। চাষিকে মানসম্মত ব্রুড থেকে উৎপাদিত এবং অন্তঃপ্রজনন মুক্ত পোনা, একই আকারের ও বয়সের রোগমুক্ত পোনা সংগ্রহ করতে হবে। অদক্ষ এবং অনভিজ্ঞ হ্যাচারী টেকনেশিয়ানরা মৎস্য চাষিদের যেভাবে প্রতারিত করছে তা থেকে চাষিদের রক্ষা পেতে হবে। মনে রাখতে হবে যেমন বীজ তেমন ফল। ভাল পোনা না হলে কেবল খাবারের উপরই দোষ চাপালে ঠিক হবে না।

পোনা পরিবহন ও অবমুক্তকরণে ত্রুটি
মানসম্পন্ন পোনা সংগ্রহ করার পর তা সঠিক নিয়মে পরিবহণ এবং পরিবহণের পর যথার্থভাবে পুকুরে অবমুক্ত করতে হবে। কেননা অনেক সময় দেখা যায় পরিবহণজনিত ত্রুটি থাকায় এবং পরিবহণের আগে পোনা সঠিক নিয়মে টেকসই করা হয় না বলে পোনা ব্যাপক হারে মারা যায়। অনেক সময় তাৎক্ষণিক ভাবে মারা না গেলেও পোনা এতই দুর্বল থাকে যে দু'এক দিনের মধ্যে অনেক পোনাই মারা যায়। বিষয়টি মাছ চাষি বুঝতে না পারলে পরবর্তীতে আরো সমস্যা ও ক্ষতি হয়ে থাকে। এ কারণে পোনা পরিবহন ও পোনা ছাড়ার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ নেয়া উচিত।

পোনা সঠিকভাবে নার্সিং
মাছ চাষি হ্যাচারী থেকে যেসব পোনা সংগ্রহ করেন তার অধিকাংশই সরাসরি চাষ পুকুরে ছাড়ার উপযোগী নয়। চাষ পুকুরে ছোট পোনা সরাসরি ছেড়ে অনেক সময় চাষি ক্ষতিগ্রস্থ হন। এতে ব্যাপক হারে পোনা মারা যেতে পারে। আর বেশি পোনা মারা গেলে চাষি ভুল পথে পরিচালিত হতে পারেন। এ কারণে পোনা ভালভাবে নার্সিং করতে হবে। নার্সিং করার পর পোনা বড় ও টেকসই হলে গণনার মাধ্যমে পোনা মজুত পুকুরে দেয়া যায় এবং পরবর্তীতে খাবার ব্যবস্থাপনার সাথে অন্যান্য ব্যবস্থাপনাও যথার্থ হতে হবে। একক চাষের ক্ষেত্রে বিশেষত শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া প্রভৃতি মাছের পোনা হ্যাচারী থেকে সরাসরি চাষ পুকুরে দিয়ে অনেক চাষি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাই নার্সিং বিশেষ জরুরি।

পোনা মজুতে সংখ্যা ঠিক রাখা
ইচ্ছেমত বা পুকুরের জায়গার তুলনায় অধিক পরিমাণে পোনা ছাড়া আমাদের মৎস্য চাষিদের একটি প্রচলিত ত্রুটি। তাদের ধারণা বেশি পোনা ছাড়া হলেই বেশি উৎপাদন হবে। অনেক সময় তাদেরকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দিলেও তা অনুসারিত হয়নি। চাষের ধরণ, অবকাঠামো, পানি বদলানোর সুবিধা, খাবারের ধরণ, মাছ চাষের মেয়াদ, মাছের প্রজাতি প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে পোনা মজুতের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ চাষি বা অভিজ্ঞ মৎস্য কর্মকর্তার কাছ থেকে তারা পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। বেশি পোনা নয় বরং পরিমিত পরিমাণে পোনা ছেড়ে অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করাই হচ্ছে গুরুত্বপুর্ণ।

মিশ্রচাষে জাত নির্বাচনে ব্যর্থতা বা অদক্ষতা
মিশ্রচাষে সাধারণত নানা প্রজাতির মাছ চাষ করা হয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রেও নিয়মকানুন রয়েছে। পুকুরে পানির তিনটি স্তরে একই রকমের মাছ থাকে না। এ কারণে মিশ্রচাষে প্রজাতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে উপরের স্তর, মধ্য স্তর এবং নীচের স্তরের বিষয়টি বিবেচনা করে প্রতিটি স্তর সঠিক ব্যবহারের জন্য প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে। অনেক সময় মৎস্য চাষিরা কোনো একটি স্তরে অধিক মাছ ছেড়ে দেন অথচ অন্য একটি স্তরের উপযোগী মাছ ছাড়েন না। এতে চাষে ভাল ফলাফল আসে না। তাছাড়া একই স্তরে বসবাসকারী অধিক মাছের জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে হয়। তাই প্রতিটি স্তরের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য আনুপাতিক হারে মাছ ছাড়তে হবে। পরস্পরে প্রতিদ্বন্ধিতা হয় এমন প্রজাতি এড়িয়ে যাওয়া ভাল। যেমন, নীচের স্তরে মৃগেল, মিররকার্প, কার্পিও এ ধরনের মাছ থাকে। পোনা ছাড়ার সময় আনুপাতিক হারেই পোনা ছাড়তে হবে। একই সাথে মৃগেল এবং গলদা চিংড়ি ছাড়া হলে গলদা চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার মাংসভোজী অর্থাৎ একে অপরকে খেয়ে ফেলে এ ধরনের প্রজাতি মিশ্রচাষে দেয়া যাবে না। মিশ্রচাষে রাক্ষুসে প্রজাতিকে এড়িয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক।

পানির গুণাগুণ রক্ষা
মাছ পানিতে থাকে বলেই পানির গুণাগুণ ও পরিবেশ রক্ষা করাটা জরুরি। অথচ অনেক মৎস্য চাষি পানির গুণাগুণ রক্ষায় সচেষ্ট নন। মাছ চাষের জন্য পানির নির্ধারিত স্থিতিমাপ রয়েছে। এগুলো দক্ষতার সাথে রক্ষা করতে পারলে চাষকালীন সময়ে নানা সমস্যা এড়ানো সম্ভব। পানির পিএইচ (PH), অ্যামোনিয়া, ক্ষারত্ব, দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রভৃতির আদর্শ মাত্রা রয়েছে। এ মাত্রা অতিক্রম করলে বা অস্বাভাবিক কমবেশি হলেই বিপত্তি। চাষিরা টেস্ট কিটের (Test kit) এর মাধ্যমে উপরোক্ত মাত্রা পরিমাপ করে পানির গুণাগুণ জানতে পারেন এবং অভিজ্ঞ চাষি করণীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এ কারণে চাষিদের জন্য টেস্ট কিট রাখা অতি জরুরি।

মানসম্মত খাবার দেয়া
লাভজনক মাছ চাষের জন্য মানসম্মত খাবার প্রদান অন্যতম প্রধান শর্ত। কেননা মাছ চাষে ৭০% এর বেশি খরচ হয় কেবল খাদ্য সরবরাহে। বাজারে নানা কোম্পানীর খাদ্য রয়েছে এবং অনেকে নিজে খাদ্য তৈরি করে সরবরাহ করেন। খাবার যে ভাবেই সরবরাহ করা হোক না কেন তা অবশ্যই মানসম্পন্ন হতে হবে। সঠিক পুষ্টিমান সম্পন্ন এবং মাছের আকার ও বয়স উপযোগী খাবার সরবরাহ না করলে মৎস্য চাষি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। অনেক চাষি অজ্ঞতা, সস্তা বা বাকীতে পাবার জন্যে খুবই নিম্নমানের খাবার ক্রয় করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এ ব্যাপারে তাদের সচেতনতা প্রয়োজন। তাছাড়া পরীক্ষাগারে খাদ্য পরীক্ষা করালে খাদ্যের পুষ্টিমান সম্পর্কে জানা যায়।

খাবার কম-বেশি সরবরাহ করা
কম খাবার সরবরাহ করলে যেমন মাছের প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়া যায় না, তেমনি বেশি পরিমাণে খাবার সরবরাহে চাষি অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। এতে খাবার ও অর্থ দুই-ই অপচয় হয় এবং পানি দূষণের জন্য মাছ মারা যেতে পারে। অধিকাংশ চাষি এ ভুলটি করে থাকেন। সাধারণত মাছের পোনার সংখ্যা তাদের অজানা থাকায় খাদ্য প্রয়োগের হিসেবে গরমিল থাকায় মাছচাষি সঠিকমাত্রায় খাবার সরবরাহ করতে পারেন না। এজন্য মাছের সংখ্যা এবং গড় ওজন জেনে পানির গুণাগুণের দিক বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পরিমাণে খাবার সরবরাহ করা অত্যাবশ্যক।

নিয়মিত খাবার সরবরাহ করা
অনেক চাষি নিয়মিত খাবার সরবরাহ করার পরিবর্তে মাঝে মাঝে ও অনিয়মিতভাবে খাবার সরবরাহ করে থাকেন। এভাবে খাবার সরবরাহ করলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া অনেক চাষি অসময়ে আবার কেউ কেউ ইচ্ছেমত খাবার দিয়ে থাকেন বলে মাছের সুষম বৃদ্ধি হয় না এবং অনেক ক্ষেত্রে খাবারের অপচয় হয়ে থাকে। অর্থাভাবে চাষের মাঝামাঝি সময়ে খাবার সরবরাহে ব্যর্থ হলে চাষি লাভবান হতে পারে না। তাছাড়া মাছ খাদ্য খাচ্ছে কি না তা অনেক চাষি লক্ষ্য করেন না।

নিয়মিত ওজন নেয়া
১০/১৫ দিন পর পর মাছের গড় ওজন নেয়া আবশ্যক। তা না হলে চাষি খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেন না। মাছের ওজন না নিলে চাষিও বুঝতে পারেন না যে মাছের বৃদ্ধি সন্তোষজনক নাকি হতাশাব্যঞ্জক। চাষিকে তাই ১০/১৫ দিন পর পর মাছের গড় ওজন নিতে হবে এবং তদনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

স্বাস্থ্য পরিচর্যা
পোনা ছেড়ে এবং খাবার সরবরাহ করেই চাষির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ একটি বড় কাজ। মাছের অস্বাভাবিক আচরণ বা দেহে অস্বাভাবিক কোনো কিছু দেখা গেলে বা ক্ষত হলে মৎস্য বিশেষজ্ঞ বা মৎস্য কর্মকর্তার শরণাপন্ন হতে হবে। তবে মাছের রোগ হলে চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধে অধিক মনোযোগী হলে মাছচাষি ক্ষতি এড়াতে পারেন। স্বাস্থ্যসম্মত চাষ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে আজকাল মাছ চাষে নানা ঔষধপত্র এবং পুষ্টি পণ্য পাওয়া যাচ্ছে যা চাষি ব্যবহার করে সুবিধা পেতে পারেন।

অতিরিক্ত সার প্রদান
মাছ চাষে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে জৈব ও অজৈব সারের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু প্রায়শ দেখা যায় যে অনেক চাষি কেবল সার প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ চাষ করতে চান। তাদের ধারণা কেবল সার প্রয়োগ করলে আর সম্পূরক খাবার দেয়া লাগবে না। এ ধারণা থেকে অতিরিক্ত সার প্রয়োগে তারা বিপদ ডেকে আনেন। পানিতে প্লাংক্টন বুম বেশি হয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে এক পর্যায়ে পানি নষ্ট হয়ে যায় এবং পুকুরে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে মাছ মারা যায়। কেবল প্রয়োজন হলেই সার দেয়া উচিত না হলে দরকার নেই।

পোল্ট্রি লিটার বা বিষ্ঠা ব্যবহার না করা
পোল্ট্রি বিষ্ঠাতে খাদ্যমান রয়েছে এ চিন্তা থেকে অনেক মৎস্য চাষি পোল্ট্রি লিটারকেই কেবল মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু লিটার ব্যবহারের কারণে চাষিরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। অনেক সময় পোল্ট্রি লিটারে কাঠের গুড়া ব্যবহার করা হয় যা মাছ খেয়ে পরিপাক হয় না এবং তা থেকে বদহজম হয়ে পেট ফুলে মাছ মারা যায়। আবার লিটারে কেবল তুষ থাকার কারণে একই সমস্যা হয়। অধিক পরিমাণে লিটার পানির গুণাগুণ নষ্ট করে। পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের কারণে ব্যাপকহারে মাছ মারা যায় এবং পানির গুণাগুণ রক্ষা করতে গিয়ে ঔষধপত্র কিনতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। তাছাড়া এ লিটারের মাধ্যমে মাছে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া যায় যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ইউরোপীয় দেশসমূহে মাছে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের দেশেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কারণে সস্তায় লাভের মানসিকতা পরিহার করতে পোল্ট্রি লিটার মাছ চাষে ব্যবহারে বিরত থাকা উচিত।

সঠিক নির্দেশনায় ঔষধপত্র ব্যবহার
আধুনিক মাছ চাষে চিকিৎসা, প্রতিরোধ এবং নানা সমস্যা মোকাবেলায় বিভিন্ন ধরনের ঔষধপত্র এবং পুষ্টিপণ্য বাজারে পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও নানা কোম্পানী নানা পণ্য বাজারজাত করছে। তবে অনেক সময় তারা সস্তায় এসব কিনে প্রতারিত হয়ে থাকেন। আবার সঠিক ব্যবহার বিধি না জানা বা সঠিক মাত্রায় ব্যবহার না করায় সুফল পাচ্ছে না। এ কারণে সঠিক মাত্রা এবং প্রয়োগ বিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে।

একাধারে একই পুকুরে মাছ ধরা
একই পুকুর থেকে একাধারে কয়েকদিন মাছ ধরলে চাষি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। কেননা পরপর কয়েকদিন জাল টানলে অন্য মাছ খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয় বলে মাছের ওজন কমে যায় এবং আঘাতজনিত কারণেও কিছু মাছ মারা যেতে পারে। এ কারণে একটানা কয়েকদিন মাছ না ধরে মাঝে বিরতি দেয়া উচিত।

আহরিত মাছ পরিবহনে সমস্যা
মাছ ধরে সঠিকভাবে বাজারজাত করতে না পারলে মাছচাষি চাষের শেষ দিকে এসে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। যেসব মাছ জীবিত পরিবহন করা হয় সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে অধিক সময় পরিবহন বা অন্য কোনো ত্রুটির কারণে মারা যায়। এ ক্ষেত্রে প্লাষ্টিক ড্রামে পরিষ্কার পানিসহ পরিমিত মাছ পরিবহন করা উচিত। আজকাল ড্রামসহ গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। শিং, মাগুর, কৈ প্রভৃতি মাছ এভাবে পরিবহন করা হয়। ড্রামে নেয়ার আগে কিছু সময় হাপায় রাখা আবশ্যক। মাছ ধরার ৮/১০ ঘন্টা আগে খাবার দেয়া বন্ধ রাখলে ধৃত মাছ অধিক সময় জীবিত থাকে। অন্যান্য মাছ দূরত্ব ভেদে বরফজাত করা উচিত।
মাছচাষিরা একটু সতর্ক হলে এবং চাষকালে প্রতিটি ধাপে দক্ষতার পরিচয় দিলে ক্ষতি বা লোকসান থেকে রক্ষা পেয়ে নিশ্চিত লাভবান হতে পারবেন।
                                                                                               তথ্যঃ সংগৃহীত





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ঝিনুক থেকে মুক্তা তৈরির রহস্য.......

মাছ, পোল্ট্রি, প্রাণিখাদ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্ল্যাক সোলজার মাছির (Black soldier fly) লার্ভা:

মাছের আঁইশের নানাবিধ ব্যবহারঃ